জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আফসোস করেছেন কোচ আবদেল হামিদ কারমালি। হতাশার আগুনে পুড়েছে আলজেরিয়াও। জিনেদিন জিদান আলজেরিয়ার জাতীয় দলে খেলার জন্য কত অনুনয়-বিনয়ই না করেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন আলজেরীয় কোচ কারমালি ধীরগতির ফুটবলার বলে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন জিদানকে। প্রত্যাখ্যাত হয়ে জিদান হয়তো কেঁদেছিলেন। মনে মনে হয়তো এর উত্তর দেওয়ার পথও খুঁজছিলেন। তারপর ফরাসি জার্সিতে ফুটবল বিশ্বে কী বিপ্লবই না ঘটিয়ে দিলেন। ম্যারাডোনার পর একক প্রচেষ্টায় ফ্রান্সকে এনে দিয়েছেন বিশ্বকাপের শিরোপা। ফরাসিদের ইউরো কাপ চ্যাম্পিয়নও করেছেন তিনি। ২০০৬ সালেও একক প্রচেষ্টায় ফ্রান্সকে বিশ্বকাপের দ্বিতীয় শিরোপার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ইতালির ডিফেন্ডার মাতারাজ্জির ফাঁদে পড়ে ফাইনালে লাল কার্ড দেখেন জিদান। ফ্রান্স টাইব্রেকারে হেরে যায় ইতালির কাছে। কিন্তু জাদুকরি ফুটবল উপহার দেওয়ায় ভক্তদের মন জয় করে নেন জিদান। সেরা ফুটবলারও নির্বাচিত হন ওই আসরের। উৎফুল্ল ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাক তো জিনেদিন জিদানকে 'জাতীয় বীর' হিসেবে ঘোষণা দেন।
আর্জেন্টাইন ফুটবল ঈশ্বর দিয়েগো ম্যারাডোনার পর জিদানই বিশ্বের প্রথম ফুটবলার যিনি একক প্রচেষ্টায় একটি দলকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন। তাছাড়া জিদান ছিলেন গ্রেট ফুটবলারদের মধ্যে গ্রেট। তিনি দুই পায়েই ড্রিবলিং করতে পারতেন। ফুটবল ইতিহাসে যা বিরল। জিদানের ট্রেডমার্ক ফ্রি-কিক প্রতিপক্ষের গোলরক্ষকরা বুঝতেই পারতেন না। নিজেদের রক্ষণভাগ থেকে বল নিয়ে জিদান ড্রিবলিং করতে করতে অনায়াসে ঢুকে পড়তেন প্রতিপক্ষের ডি-বক্সে বল যেন আঠার মতো লেগে থাকতো তার পায়ের সঙ্গে। মনে হতো সুতো দিয়ে বাঁধা! ফরাসি এই তারকা মাঠে দ্বৈত ভূমিকা পালন করতেন। কখনো মিডফিল্ডার, আবার কখনো স্ট্রাইকার। ক্লাব ফুটবলে সেরা সময় কাটিয়েছেন স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ ও ইতালির জুভেন্টাসে। মেধা-মনন, কৌশলে জিদান বিশ্বে অদ্বিতীয়। তাই তো ম্যারাডোনা-পেলের মতো গ্রেট তারকারা থাকার পরও জিনেদিন জিদানকে বলা হয় বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা ফুটবলার।
ফ্রান্স জাতীয় দলে জিদানের অভিষেক ১৯৯৪ সালের ১৭ আগস্ট, চেক প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে। ৬৩ মিনিটে বদলি খেলোয়াড় হিসেবে যখন মাঠে নামেন, তখন ফ্রান্স ২-০ গোলে পিছিয়ে। প্রথম ম্যাচেই ম্যাজিক, দুই দুটি গোল করে ম্যাচে সমতা আনেন জিদান। অসাধারণ ফুটবল খেলে প্রথম ম্যাচেই জাত চিনিয়েছিলেন নিজের। এরপর সুপারস্টার জিদানকে ফুটবল দুনিয়া দেখল ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপে। ফাইনালে ব্রাজিলকে তো পাত্তাই দেয়নি জিদানের ফ্রান্স। ঘরের মাঠে ৩-০ গোলে ব্রাজিলকে উড়িয়ে দিয়ে প্রথমবারের শিরোপার স্বাদ পায় ফরাসিরা। জিদান একাই দুই গোল করে ম্যাচ সেরার পুরস্কার পান।
২০০০ সালেও জিদান একক নৈপুণ্যে ফ্রান্সকে এনে দেন ইউরোপীয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা। স্পেনের বিপক্ষে সরাসরি ফ্রি কিক থেকে দুর্দান্ত গোল করে ফরাসিদের কোয়ার্টার ফাইনালে তোলেন। তারপর সেমিফাইনালে পর্তুগালের বিপক্ষে পেনাল্টিতে গোল্ডেন গোল করে দলকে ফাইনালে নিয়ে যান। শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে ইতালিকে হারিয়ে ১৬ বছর পর ইউরো সেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করে ফরাসিরা। ফিফা র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে ওঠে ফ্রান্স।
২০০২ বিশ্বকাপে ইনজুরি আক্রান্ত জিদান ঠিকমতো খেলতেই পারেননি। ফ্রান্সও প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নেয়। ২০০৪ সালে ইউরোপীয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়ে ফ্রান্সকে কোয়ার্টার ফাইনালে তোলেন। কিন্তু শেষ আটের লড়াই অপ্রত্যাশিতভাবে ফরাসিরা হেরে যায় গ্রিসের কাছে। ভক্তদের কাঁদিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসরের ঘোষণা দেন এই মহানায়ক। কিন্তু ২০০৬ সালে বিশ্বকাপের বাছাই পর্ব উৎরাতে যখন ফ্রান্স হিমশিম খাচ্ছিল, দলের বিপদের সময় ঠিকই অবসর ভেঙে আবার মাঠে নামেন জিদান। তারপর দাপটের সঙ্গে চূড়ান্ত পর্বে জায়গা করে নেয় ফরাসিরা। শুধু তাই নয়, ২০০৬ সালের বিশ্বকাপে তো ফ্রান্সকে বিশ্বকাপের দ্বিতীয় শিরোপা প্রায় এনেই দিয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিল না।
জিনেদিন জিদানের ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু হয় মার্শেইয়ের লা ক্যাস্তেইল্যান নামক একটি স্থানীয় ক্লাবের জুনিয়র দলে। সবাইকে তাক লাগিয়ে জিদান মাত্র ১৭ বছর বয়সেই প্রথম বিভাগ ম্যাচ খেলেন। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এর কান ও বোরডিঙ্ েক্লাবের হয়ে খেলেন। ১৯৯৬ সালে জিদান ইতালির জুভেন্টাস এফসি ক্লাবে যোগ দেন। ৫ বছরে জুভেন্টাসকে দুবার দুবার 'সিরি-এ' এর শিরোপা এনে দেন। ২০০১ সালে জিদান জুভেন্টাস থেকে রেকর্ড পরিমাণ ৬৬ মিলিয়ন পাউন্ড ট্রান্সফার ফি'তে ৪ বছরের জন্য রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেন। সেখানে তার দ্যুতি ছড়িয়ে ২০০৬ সালে মাদ্রিদে ভক্তদের কাঁদিয়ে বিদায় নেন জিদান।
২০০৬ সালের নভেম্বরে জিদান নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসের অতিথি হিসেবে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। মোহামেডান ও আবাহনীর হয়ে একটি প্রীতিম্যাচেও অংশ নিয়েছিলেন। ওই ম্যাচে জিদান ৩০ মিনিট মোহামেডানের এবং ৩০ মিনিট আবাহনীর জার্সিতে খেলেন। ম্যাচটি গোলশূন্য ড্র হলে বাংলাদেশি মন জয় করে নেন ফরাসি এই ফুটবলের এই মহানায়ক।