হাওররের জনপদ সুনামগঞ্জে ট্রাজেডির আরেক নাম বজ্রপাত। প্রতি বছর বজ্রপাতে প্রাণ ঝরছে অসংখ্য মানুষের। বৃষ্টির মৌসুম এলেই হাওরাঞ্চলে দেখা দেয় বজ্রপাতের শঙ্কা। দেশের সবচেয়ে বজ্রপাতপ্রবণ এ জেলায় এখন আতঙ্কের বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বজ্রপাতে হতাহতের সংখ্যা নিয়ে।
২০১৮ সাল থেকে ২০২১ এই ৪ বছরে সুনামগঞ্জ জেলায় বজ্রপাতে মৃত্যুবরণ করেছেন অর্শধতাধিক ব্যক্তি। এছাড়াও ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বজ্রপাতে আরও অর্ধশত প্রাণ হারানোর তথ্য রয়েছে স্থানীয় গণমাধ্যম ও বেসরকারি সংস্থার কাছে। যদিও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কাছে বজ্রপাতে মৃত্যু সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই।
সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার ও জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সুনামগঞ্জে সবচেয়ে বেশি মানুষ বজ্রপাতে মারা যায় ২০১৮ সালে। সেই বছর সুনামগঞ্জের হাওরগুলোতে বজ্রপাতে ২৫ জন মারা যান এবং সেটিই সুনামগঞ্জের এক বছরের সর্বোচ্চ মৃত্যু। ২০১৯ সালে প্রাণ হারান ৯ জন, ২০২০ সালে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছেন আরও ১০ জন এবং চলতি বছরের ১৯ মে পর্যন্ত বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে ৭ জনের।
২৮ এপ্রিল ধান কাটতে গিয়ে প্রাণ হারান দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়ার ইউনিয়নে মধুরাপুর গ্রামের ফকরুল ও ফজলু মিয়া নামের দুই সহোদর। পরিবারের দুই উপার্জনক্রম ব্যক্তিকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে পরিবারটি। দুই পরিবারের ১২ সদস্য নিয়ে শোক সাগরে ফজলু ও ফখরুলের স্ত্রী। এছাড়াও বজ্রপাতে দোয়ারাবাজারে ২ জন, বিশ্বম্ভরপুর ১ জন, দক্ষিণ সুনামগঞ্জে ১ জন, ছাতক উপজেলায় ১ জনসহ মোট ছয় জনের মৃত্যু হয়। ২০১৯ সালে বজ্রপাতে একই পরিবারের পিতাপুত্রের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে তিনটি।
বজ্রপাতের কবলে মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তিদের মধ্যে কৃষক, জেলেসহ নিম্ন আয়ের মানুষের সংখ্যাই বেশি। দুর্যোকালীন সময়ে চাষাবাদ, ফসল সংগ্রহ ও মৎস্য আহরণের ক্ষেত্রে বজ্রপাতের শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। দেশের বজ্রপাত প্রবল এলাকায় বজ্রপাত প্রতিরোধে এখনও পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি সরকারের পক্ষ থেকে। তাই দাবি উঠেছে হাওর এলাকায় বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্র স্থাপনের।
এদিকে ২০১৭ সালের নাসা ও মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় বলা হয়, সারা বিশ্বে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কঙ্গোর কিনমারা ডেমকেপ এলাকায়, মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বাংলাদেশের সুনামগঞ্জে জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত আঘাত হানে। সুনামগঞ্জে মার্চ থেকে মে এ তিন মাসে প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় ২৫টিরও বেশি বজ্রপাত আঘাত হানে। ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে দেশের পূর্বাঞ্চলে বজ্রপাতের পরিমাণ প্রাকৃতিকভাবেই বেশি। ভারতের খাসিয়া পাহাড় ও মেঘালয় এলাকায় মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত মেঘ জমে থাকে। স্থরীভূত মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে ওই এলাকার পাদদেশে অবস্থিত সুনামগঞ্জ জেলায় বজ্রপাতের সংখ্যাও বেশি হয়ে থাকে।
আর এ বজ্রপাতে বাংলাদেশের হাওর প্রধান জেলা সুনামগঞ্জে প্রতিবছর প্রাণ হারায় অনেক মানুষ। হাওর প্রধান জেলা হওয়ায় কৃষি ও মৎস্য আহরণ এই দুইটি সুনামগঞ্জের আয়ের প্রধান উৎস হলেও সেই হাওরেই প্রতিবছর বজ্রপাতে প্রাণ দিতে হয় অনেককে। সরকার থেকে বজ্রপাতে মারা যাওয়া পরিবারকে ২০ হাজার টাকা ও আহত ব্যক্তিকে ৫ হাজার টাকা করে প্রদান করা হয়। তাছাড়া বজ্রপাতে মারা যাওয়া পরিবাররের পুনবার্সনের জন্যে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ হয়নি। পরিবারের আয়ের একমাত্র ব্যক্তিকে হারিয়ে পথে বসার উপক্রম হয় অনেকের।
সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার চরানচর ইউনিয়নের ললুয়ারচর গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল খালেক। ২০২০ সালের ৪ জুন প্রবল বৃষ্টিপাত ও ঝড়ের মধ্যে উপজেলার মিলন বাজার সংলগ্ন হাওরে মাছ ধরতে গিয়ে বজ্রপাতে মারা যান আব্দুল খালেকের বড় ছেলে তকবির হোসেন (২০)। তকবির ছিলেন একজন জেলে। হাওরে মাছ শিকার করে আয়ের টাকা দিয়েই পরিবারের ভরণ পোষণ হতো। কিন্তু একটি দুর্ঘটনায় পরিবারের কোনো সদস্যও ভালো নেই। ছেলে মারা যাওয়ার পর আব্দুল খালেকের সুখের জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। ছেলে মারা যাওয়া পর পুনবার্সনের জন্য কোনো সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।
খালেক মিয়া বলেন, আমার ছেলে তকবির হোসেন হাওরে মাছ ধরতো। আমার তিন ছেলে এক মেয়ের সংসারে সে ছিল সবার বড়। কিন্তু গেল মাসের ৪ জুন টেলা জাল দিয়ে হাওরে মাছ ধরতে গিয়ে আমার ছেলে বজ্রপাতে মারা যায়। ‘সে মারা যাওয়ার পর থাকি আমি রোজ কামলার কাজ করি। কোনদিন ১৫০ টাকা তো কোনদিন ২০০ আবার কোনদিন এক টাকাও না। আমার ছেলে মারা যাওয়ার পর পুনবার্সনের জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি। এছাড়া কোন ব্যাংকও আমাদের ঋণ দেয় না’।
দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়ার ইউনিয়নে মধুরাপুর গ্রামের ফজলু ও ফখরুল নামে দুই ভাই ছিলেন বর্গা চাষী। ২৮ জুন ধান কাটতে গিয়ে বজ্রপাতে নিহত হন। ফজলু ও ফখরুলের পরিবারে বৃদ্ধা মা, স্ত্রী সন্তানসহ সদস্য ১২ জন। পরিবারের উপার্জনক্রম ব্যক্তি হারিয়ে শোক সাগরে পরিবারটি। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিতের দিকে নাবালক সন্তানদের।
এভাবে বজ্রপাতে পরিবারের কর্তাব্যক্তিকে হারিয়ে দিশেহারা অনেক পরিবার। বজ্রপাতে নিহত পরিবারের পাশে সরকারের পাশাপাশি মানবিক সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে আহবান জানিয়েছেন সচেতন মহল।
এদিকে হাওরে বজ্রপাত থেকে মানুষদের সচেতন ও প্রাণহানি কমাতে তালগাছ না লাগিয়ে হাওরে ও খোল জায়গায় নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে বজ্র নিরোধক যন্ত্র লাগানো ও বজ্রপাতে মারা যাওয়া পরিবারকে মোটা অংকের একটি অনুদান এবং সকল হাওরের কৃষক ও মৎস্যজীবীদের মধ্যে বজ্রপাত থেকে নিরাপদ থাকার জন্য সচেতনমূলক প্রচারণা জোরদার করার দাবি জানান হাওর উন্নয়নে সংশ্লিরা।
হাওর হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, সুনামগঞ্জ সবচেয়ে বজ্রপাত প্রবণ এলাকা। প্রতি বছরই বজ্রপাতে প্রাণ যায় নিম্নআয়ের মানুষের। সরকারকে সুনামগঞ্জ জেলার প্রতি গুরুত্ব প্রদান করে হাওর ও খোলা জায়গায় অতিদ্রুত বজ্র নিরোধক যন্ত্র স্থাপনের আহাবান জানান তিনি।
এছাড়া মারা যাওয়া পরিবারের পুনবার্সনে আর্থিক অনুদানসহ হাওর এলাকার মানুষদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করার তাগাদা জানান বিজন সেন।
জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, সুনামগঞ্জে প্রতি বছর হাওরে কাজ করতে গিয়ে বজ্রপাতে কৃষক, জেলেসহ নিম্ন আয়ের মানুষ মারা যান। বজ্রপাতে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে হাওরে গাছ লাগানোর কথা চিন্তা করছি আমরা।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বজ্রপাতে নিহত পরিবারকে এককালীন ২০ হাজার ও আহত ব্যক্তিকে ৫ হাজার টাকা প্রদান করা হচ্ছে।
বিডি প্রতিদিন/আরাফাত